পন্টুন স্থাপনে বাধা

লাঘব হচ্ছে না মহেশখালী নৌপথের দুর্ভোগ

সায়ীদ আলমগীর •

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের বাসিন্দা বৃদ্ধ আবদুল কাদের অসুস্থ। শনিবার (২৯ জুলাই) তাকে চিকিৎসার জন্য বিমানে ঢাকা নিতে বেরিয়ে মহেশখালী জেটিঘাটে পৌঁছান স্বজনরা। কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে সকাল সাড়ে ৯টার ফ্লাইটে টিকিট কাটা তাদের। সকাল পৌনে ৮টায় জেটিঘাটে এসে তারা দেখতে পান লোকজনের লম্বা লাইন। ঘাটে নৌকা বাঁধা, তবে চালকরা নেই।

কিছুক্ষণ পর কয়েকজন চালক এসে নৌকা ছাড়তে শুরু করেন। আর যাত্রীদের জটলা দেখে ৯ জন করে নিয়ে ছাড়তে শুরু করে স্পিডবোট। এভাবে প্রায় আধাঘণ্টা অপেক্ষার পর কক্সবাজার থেকে যাওয়া একটি স্পিডবোট মহেশখালী ঘাটে ভিড়লে তা নিয়ে জেটি ত্যাগ করেন আবদুল কাদের ও তার স্বজনরা।

শুধু আবদুল কাদের নন, এভাবে নিত্যদিন কর্মঘণ্টা নষ্ট করে নৌকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় মহেশখালীর অসংখ্য মানুষকে। এদের মাঝে শিশু, বৃদ্ধ, নারী, রোগী, শিক্ষার্থী, চাকরিজীবীসহ নানা পেশার লোকজন থাকেন।

এভাবে প্রতিদিন ভোগান্তি পেরিয়ে কক্সবাজারে নিজের কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মুবিনূল হক। তার মতে, প্রতিদিন ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকতে হয় মহেশখালী ঘাটে। জেলা সদরে প্রশিক্ষণ থাকলে দুয়েক ঘণ্টা আগে বেরিয়েও সঠিক সময়ে স্পিডবোট না ছাড়ায় সময়মতো পৌঁছানো যায় না।

জানা যায়, মহেশখালী উপজেলার একটি পৌরসভা ও আটটি ইউনিয়নের চার লক্ষাধিক মানুষের কক্সবাজার সদরের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম নৌপথ।

অভিযোগ রয়েছে, এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে কক্সবাজার-মহেশখালী নৌপথকে টাকা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে পৌর মেয়রের নেতৃত্বে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে আঁতাত করে প্রশাসনের লোকজন ঘাটের অনিয়ম দেখেও কোনো ব্যবস্থা নেন না।

সূত্র আরও জানায়, সকালে ঠিক সময়ে নৌকা না ছাড়ায় ঘাটে যাত্রীদের ভিড় লেগে থাকে। কেউ ঘাটের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রতিবাদ করলে ঘাটের দায়িত্বরতদের রোষানলে পড়তে হয়। এরইমধ্যে তাদের হাতে অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। স্পিডবোট চালকদের মনগড়া নিয়মের বাইরে কথা বলারও সুযোগ নেই। তারা যাত্রীদের ভিড়কে পুঁজি করে অতিরিক্ত ভাড়াও আদায় করেন। এছাড়া জেটিঘাটের সংস্কার না থাকায় জোয়ারে নৌকায় ওঠা গেলেও ভাটায় কাঁদা মাড়িয়ে ওঠানামা করতে হয়।

এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে দ্বীপবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রোববার (৩০ জুলাই) সকালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) যাত্রী ওঠানামায় মহেশখালী ঘাটে একটি পন্টুন স্থাপন করে। এ খবর পেয়ে মহেশখালী পৌরসভার উপ-সহকারী প্রকৌশলী সাইদুল ইসলামের নেতৃত্বে ১০-১৫ জন পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘাটে এসে পন্টুন বাঁধার রশি কেটে দেন। পরে গামবোটের (এক ধরনের সার্ভিস বোট) সহায়তায় তারা পন্টুনটি সাগর ও নদীর মোহনায় ভাসিয়ে দেন বলে অভিযোগ করেন বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা।

বিআইডব্লিউটিএর ট্রাফিক সুপারভাইজার মুহাম্মদ আজাদ হোসেন বলেন, পন্টুনটি ঘাটে স্থাপনের পরপরই একদল লোক এসে অকথ্য গালিগালাজ করে নিরাপত্তার জন্য বেঁধে রাখা রশি কেটে দেয়। ঘাটে পন্টুন স্থাপনে বাধা দিয়ে তারা এটিকে ঘাটের আশপাশে নোঙরও করতে দেয়নি। মারমুখি হয়ে গামবোটের সহায়তায় বিআইডব্লিউটিএর চার কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ পন্টুনটি টেনে সাগর মোহনায় ভাসিয়ে দেয়। আমরা ৯৯৯-এ বিষয়টি জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।

মহেশখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) তাজউদ্দীন বলেন, ৯৯৯-এ অভিযোগ পেয়ে আমাদের একটি টিম ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। বিআইডব্লিউটিএ এখনো লিখিত কোনো অভিযোগ দেয়নি।

মহেশখালী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমজাদ হোসেন বলেন, জেটিঘাট দিয়ে আসা-যাওয়ার টোল হিসেবে বোট ভাড়ায় নিয়মের চেয়ে জনপ্রতি ১০ টাকা বেশি আদায় করা হয়। এক্ষেত্রে পন্টুনটি বসানো হলে মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও লাঘব হতো। আসলে মহেশখালীর পৌর মেয়র মকছুদ মিয়া উপজেলার তালিকাভুক্ত যুদ্ধাপরাধী হাশেম সিকদার ওরফে বড় মোহাম্মদের ছেলে। তিনি কৌশলে পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে গায়ে মুজিব কোট পরলেও তার মনে মুজিব আদর্শের ছিটেফোঁটাও নেই। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের কষ্ট ও ভোগান্তি লাঘবে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন সেখানে ভোগান্তি বাড়াতেই সরকারি পন্টুনটি ঘাটে ভিড়তেই দেননি পৌর মেয়র। এ কাজে পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার করা হয়েছে। এটা ফৌজদারি অপরাধ। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।

মহেশখালী পৌরসভার উপ-সহকারী প্রকৌশলী সাইদুল ইসলাম বলেন, মেয়রের নির্দেশেই আমরা পন্টুনটি সরিয়েছি। ওখানে পন্টুন স্থাপনের বিষয়টি পৌরসভাকে অবহিত করা হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহেশখালী পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মকছুদ মিয়া বলেন, ঘাটটি পৌরসভার। ওখানে পন্টুন স্থাপন করতে আমাদের অফিসিয়ালি জানানো হয়নি। পন্টুন বসিয়ে টাকা নয়ছয় করে জনগণের ভোগান্তি বাড়াতেই সবাইকে অন্ধকারে রেখে পন্টুন আনা হয়েছে। সেবার নামে মহেশখালীবাসীর পকেট কাটতে দেব না আমি। পন্টুনের বিষয়ে পৌরসভার সঙ্গে তাদের চুক্তি কী হবে এসব আগে নিশ্চিত করতে হবে।

বিআইডব্লিউটিএ চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক (ডিডি) নয়ন শীল বলেন, দ্বীপবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার এমপি আশেক উল্লাহ রফিকের চাহিদার ভিত্তিতে নানা প্রচেষ্টার পর রোববার ঘাটে পন্টুন স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু পৌর মেয়র দুর্বৃত্ত স্টাইলে পন্টুনটি না সরিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। আমার লোকজনসহ সাগরে ভাসমান পন্টুনটি রাত ১২টা নাগাদ কক্সবাজার বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে আনা হয়। বিষয়টি এমপিকে জানানো হয়েছে। আজকালের মধ্যে জেলা প্রশাসককে সঙ্গে নিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মহেশখালী ঘাটের দুর্ভোগের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, ঘাটে কাঠ ও ডেনিস বোট প্রয়োজন মতো থাকে। কিন্তু অনেকেই এসবে না উঠে স্পিডবোটের জন্য দাঁড়ান। স্পিডবোট যদি কক্সবাজার ঘাটে যায়, আর সেদিক থেকে যাত্রী না পায়, তখন জ্বালানি খরচ ওঠে না বলে তারা খালি আসে না। এ অবস্থায় যাত্রীরা কাঠ বা ডেনিস বোটে যাতায়াত করতে পারে। যারা প্রয়োজন বোঝে তারা এসব বোটে যায়, আর প্রয়োজন না থাকলে অনেকে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ বিষয়ে প্রশাসনের কিছুই করার থাকে না। আর পন্টুন বসানো দুই বিভাগের সমন্বয়ের বিষয়।

কক্সবাজার স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক (ডিডিএলজি) মো. নাসিম আহমেদ বলেন, মহেশখালী ঘাটে পন্টুনের বিষয়ে কোনোপক্ষই আমাকে অবহিত করেনি। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আলোচনা হলে বিষয়টি সমাধানযোগ্য।

এ বিষয়ে কথা বলতে মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিকের মোবাইল ফোনে কল করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।